আজ
|| ১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ১৪ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
সিরাজগঞ্জে কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা
প্রকাশের তারিখঃ ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
সিরাজগঞ্জে কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা-----
স্টাফ রিপোর্টারঃ-
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নওগাঁ এলাকায় শীতের দিনে কুমড়ার বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারীরা।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এক খাবার কুমড়া বড়ি। স্বাদ ও পুষ্টিগুণে বিশেষ ভূমিকা রাখে এই কুমড়া বড়ি। শীত মৌসুম এলেই সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কুমড়া বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। এ অঞ্চলের সুস্বাদু কুমড়া বড়ি মানসম্মত হওয়ায় বাজারে চাহিদাও ব্যাপক। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কুমড়া বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী ও ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার সদর, কাজিপুর, কামারখন্দ, রায়গঞ্জ, তাড়াশ, শাহজাদপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও উল্লাপাড়ার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার এই কুমড়া বড়ি তৈরির সঙ্গে যুক্ত। এখানকার কুমড়ার বড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভোজনরসিকদের কাছে এটির রয়েছে আলাদা চাহিদা। গ্রামের পিছিয়ে পড়া মানুষের অনেকের ভাগ্য উন্নয়নে কুমড়ার বড়ি ভূমিকা রেখেছে। শ্রম দিয়ে তারা অনেক বছর ধরে এ কুমড়ার বড়ি তৈরি করে আসছেন। শুধু তৈরি নয়, কুমড়ার বড়িগুলো রোদে শুকানোর পর বিক্রির জন্য প্রস্তুতও করেন তারা। ফলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই জেলার তৈরি কুমড়ার বড়ি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
তাড়াশের নওগাঁ ও রায়গঞ্জের ধানগড়া গ্রামে দেখা যায়, একেক স্থানে ১০ থেকে ১২ জন নারী একত্র হয়ে কাজ করছেন। কেউ কেউ কুমড়ার বড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো একত্র করে মাখাচ্ছেন। ৪ থেকে ৫ জন কাপড়ের মধ্যে তুলে বিশেষ কায়দায় বড়ি তৈরি করছে। দুই উপজেলার গ্রামে ঢোকার আগেই রাস্তার দু’পাশে এমন দৃশ্য দেখা যায়। আরো কাছে গিয়ে দেখা যায়, কুমড়ার বড়ি শুধু তৈরি নয়, সেগুলো রোদে শুকানোর কাজে আরো কয়েকজন কাজ করছে। কেউ কেউ আগের তৈরি কুমড়া বড়ি বিক্রির জন্য প্রস্তুত করতেও দেখা যায়।
নওগাঁ গ্রামের কুমড়া বড়ির কারিগর আল্পনা খাতুন বলেন, “আগের রাতে মাসকলাইয়ের ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সকালে সেই ডালগুলো পাটায় বা ব্লেন্ডারে বেটে নেওয়া হয়। পরে চালকুমড়া কুচি করে কাটা হয়। এর সঙ্গে পরিমাণ মতো পাঁচফোড়নের গুঁড়া ও সামান্য কালোজিরা দিতে হয়। এরপরে, এই মিশ্রণ অনেকক্ষণ ধরে মাখাতে হয়। তারপর ছাদ ও পরিষ্কার স্থানের জমিতে পাতলা কাপড় পেতে ছোট ছোট করে বড়ি তৈরি করা হয়। এই বড়ি ৩ থেকে ৪ দিন ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে পরে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়।”
উল্লাপাড়ার উধুনিয়া গ্রামের নারী কারিগর শিল্পী রানী বলেন, “শীতের শুরু থেকে আমরা বড়ি তৈরি করি। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বড়ি তৈরির কাজ করি। আকাশে রোদ ভালো থাকলে তিন-চার দিন সময় লাগে বড়ি তৈরি হতে। আকাশ মেঘলা অথবা রোদ কম হলে বড়ির সমস্যা হয়, কম রোদে শুকানো বড়ির দাম বাজারেও কম। বছরে চার মাস বড়ি তৈরি করে সংসারের জন্য বাড়তি আয় হয়।”
সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামের নিয়তী বালা নামে এক কারিগর বলেন, “এক কেজি মাষকলাই থেকে ৬০০ গ্রাম বড়ি তৈরি হয়। কালাই ভাঙানো, মসলা খরচসহ ৬০০ গ্রাম বড়ি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১৫৫ টাকার মতো। বাজারে প্রতি কেজি বড়ি ৩৮০-৪০০ টাকা দরে বিক্রি করি। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি কেজি বড়িতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা করে লাভ হয়।”
আকলিমা খাতুন বলেন, “সংসারের কাজের ফাঁকে এখানে কুমড়ার বড়ি তৈরির কাজ করি। যা উপার্জন করি তা দিয়ে সংসারের খরচ হয়। এতে দিনমজুর স্বামীর কিছুটা হলেও উপকার হয়।”
কুমড়ার বড়ির ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন, “এখানে কাজ করা নারীরা সকালের শীতল পরিবেশে চাল, কুমড়া ও মাষকলাইয়ের মিশ্রণে মণ্ড তৈরি করেন। এরপর বাঁশের কাঠির তৈরি নেটে পাতলা কাপড়ের ওপর বড়ি বানানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কাজ করে নারী শ্রমিকেরা। এতে প্রতিদিন মজুরি পান ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত।”
আল-আমিন আরও বলেন, “পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে আমরা কুমড়ার বড়ি তৈরি করে আসছি। আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কাজ কিছুটা সহজ হয়েছে। তবে সরকারি সহায়তা পেলে আমরা বড় পরিসরে কুমড়ার বড়ি তৈরি করতে পারব।”
আরেক ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, “গত বছরের চেয়ে এবার কুমড়ার বড়ির চাহিদা বেড়েছে। বাজারে সাধারণ মানের কুমড়ার বড়ি প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা এবং ভালো মানের কুমড়ার বড়ি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং প্রবাসী স্বজনদের কাছেও এই বড়ি পাঠানো হচ্ছে।”
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুইচিং মং মারমা বলেন, “কুমড়ার বড়ি তৈরির মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। তাদের প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়ে ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করা হবে।”
সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক জাফর বায়েজীদ বলেন, “নারীরা সংসারের কাজের পাশাপাশি কুমড়া বড়ি তৈরি করছে। অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় এ অঞ্চলের কুমড়ার বড়ি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে। এই কাজে বাড়তি আয়ে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে। তাদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং স্বল্প সুদে ঋণসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।”
Copyright © 2025 দৈনিক সিরাজগঞ্জ কণ্ঠ. All rights reserved.